পরিবেশ সংরক্ষণে বণিক সমিতি/ব্যবসায় সংগঠনসমূহের দায়িত্ব

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | | NCTB BOOK

পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি এখন সারাবিশ্বেই ব্যাপক আলোচনার বিষয়। সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ নানান প্রকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির উচ্চহার সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে । গ্রীণ হাউজ প্রভাব আগামী ৫০ বছর পর পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে এ নিয়ে সচেতন সবাই কমবেশি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত । এই পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টিতে ব্যবসায়ীরা যে সবচেয়ে বেশি দায়ী এ বিষয়টিও পরিষ্কার। তাই শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিবেশ সুরক্ষার চাপ বাড়ছে । আমাদের দেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ দূষণে এগিয়ে । তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন ও বণিক সভাগুলো এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে তা সবাই প্রত্যাশা করে ।

বণিক সভা হলো বণিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশুনার জন্য তাদের গড়া স্বেচ্ছাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান । একটা এলাকার বা অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী একত্রিত হয়ে বণিক সভা গঠন করে । উক্ত আঞ্চলিক বণিক সভা মিলিত হয়ে আবার জাতীয় পর্যায়ে বণিক সভা গড়ে তোলে । বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসায় খাতের উন্নয়নের জন্য সেক্টরভিত্তিক ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তুলতে পারে । বাংলাদেশে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স-আঞ্চলিক বণিকসভার উদাহরণ। বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (FBCCI) জাতীয় পর্যায়ে গঠিত বণিক সভা। ঔষধ প্রস্তুতকারী শিল্প মালিক সমিতি, বাস মালিক সমিতি এভাবে নানান, ধরনের প্রতিষ্ঠান জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তুলে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশুনা, নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা এবং সরকারকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শদানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে । পরিবেশ সুরক্ষায় এ সকল সমিতি ও সংগঠনের নিঃসন্দেহে দায়িত্ব রয়েছে ।

বণিক সভা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করে । তাই ব্যবসায়ের সামাজিক দায়বোধের বিষয়টি তাদের দায়বোধেরও বিষয়। সরকার নীতি ও আইন প্রণয়ন করে । সেই নীতি ও আইন যাতে তাদের স্বার্থরক্ষা করে সেজন্য এ সকল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রয়াস--প্রচেষ্টা চালায়, দেন-দরবার করে । পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার যে সকল আইন প্রণয়ন করে সেগুলো তাদের সদস্যরা যেন মেনে চলে তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই বণিক সভা বা সংগঠনগুলোর অবশ্যই দায়িত্ব রয়েছে। একটা সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও আইনানুগ ব্যবসায় খাত গঠন ও পরিচালনায় এরূপ সংগঠনগুলোর দায়িত্ব হলো সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সাহায্য করা । দু- চারটে প্রতিষ্ঠানের কারণে যেন সমগ্র ব্যবসায় খাতের বদনাম না হয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তা দেখা সদা কর্তব্য। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণের যে সকল প্রধান প্রধান আইন ও নীতিমালা কার্যকর রয়েছে তা নিম্নরূপ :

  • পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫
  • পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭
  • পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০
  • পরিবেশ নীতি, ১৯৯৯
  • পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬ 
  • শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬
  • ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮৯
  • ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৪ 
  • শিশুদের নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৯৫
  • ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ 
  • দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ ।

উপরোক্ত আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকার বণিকসভা ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা পালনই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহায়তা গ্রহণ প্রয়োজন। বিভিন্ন বণিক সমিতিগুলো পরিবেশ দূষণ রোধে নিম্নোক্ত উপায়ে সহযোগিতা করতে পারে :

১. আইনানুযায়ী যে সকল শিল্পে বর্জ্য শোধন যন্ত্রপাতি (ETP) বসানো প্রয়োজন তা সমিতির সকল সদস্য যাতে মান্য করে তা নিশ্চিত করা;

২. কোনো শিল্প ইউনিট এই নিয়ম ভঙ্গ করলে সমিতির সদস্যপদ বাতিলসহ সমিতির পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

৩. ট্যানারি শিল্প দ্রুত ঢাকার মধ্য থেকে চামড়া শিল্প পার্কে সরাতে সরকারকে সর্বোত সহযোগিতা প্রদান করা;

৪. বিক্ষিপ্তভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান না গড়তে সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করা এবং বিভিন্ন শিল্পের জন্য পৃথক শিল্প এলাকা গড়তে সরকারকে উৎসাহিত করা; 

৫. ইটের ভাটাগুলো যেন সরকারি নিয়ম মেনে চিমনি ব্যবহার ও ইটভাটা স্থাপন করে এবং কাঠ পুড়িয়ে বন উজাড় করতে না পারে সেজন্য সমিতির পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা;

৬. মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন যাতে রাস্তায় চলতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া এবং গণপরিবহন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সরকারকে সহায়তা করা;

৭. গাড়িতে উচ্চ মাত্রায় হর্ণ ব্যবহার না করতে সদস্যদের বাধ্য করা এবং অপ্রয়োজনীয় হর্ণ যাতে বাজানো না হয় সেজন্য ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দেয়া;

৮. শিল্প বর্জ্য, হাসপাতাল বর্জ্য, তরল ময়লা ইত্যাদির অপসারণের বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা;

৯. যে সকল শিল্পে উচ্চ মাত্রার শব্দ সৃষ্টি হয় বা ধোয়া ও তরল বর্জ্য নির্গত হয় সে সকল শিল্পে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারপূর্বক তা রোধে ব্যবস্থা নিতে সদস্যদের উৎসাহিত করা; 

১০.প্রতিটা সমিতির পক্ষ থেকে পরিবেশ সুরক্ষায় মনিটরিং সেল গঠন, পর্যবেক্ষণ, তত্ত্বাবধান এবং এ বিষয়ে  স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা;

১১. পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমিতির পক্ষ থেকে উৎসাহিত ও প্রয়োজনে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা; 

১২. সমিতির আয়ের একটা অংশ পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যয়ের নির্দেশিকা জারি করা এবং বনায়ন, পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কাজে তা ব্যয় করা ইত্যাদি ।

ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীগুলোর পানি দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য এরই মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায় সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে ১৮০০ এর মত শিল্প-কারখানাকে চিহ্নিত করেছে। তাদের জন্য বর্জ্য শোধন যন্ত্রপাতি (Effluent Treatment plant /ETP) বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে । ট্যানারি শিল্প মালিক সংগঠনের সাথে আলোচনা করে সাভারে ট্যানারি শিল্প সরানোর ব্যবস্থা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকদের সংগঠনের সাথে আলাপসাপেক্ষে এর বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে । ইটভাটাগুলোতে ১২০ ফুট উচ্চতার চিমনী লাগনোতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সহযোগিতা করায় তার বাস্তবায়ন সহজ হয়েছে । যানবাহনের ধুয়া ও গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সহায়তায় ২০০২ সাল থেকে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট থ্রি হুইলার মোটরযান চলাচল ঢাকার শহরে বন্ধ করা হয়েছে । ক্ষতিকারক পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তা মান্য করা হচ্ছে। এভাবে বণিক সভা ও ব্যবসায় সংগঠনগুলোর সহায়তা গ্রহণে সরকারকে যেমনি এগিয়ে আসতে হবে তেমনি এ সংগঠনগুলোকেও নিজেদের ব্যবসায় খাতের উন্নতি ও সুনাম বজায় রাখতে ও পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবেশে বিপর্যয় ঘটালে তার হাত থেকে যে কেউই বাঁচতে পারবে না-এ বিষয়টা ব্যবসায়ী ও ব্যবসায় সংগঠনগুলো যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবে ততই এক্ষেত্রে উন্নয়ন সহজতর হবে ।

Content added By
Promotion